প্রাণিজগতের শ্রেণিকরনের ভিত্তিঃ
প্রত্যেক প্রাণিরই নিজস্ব কতকগুলো বৈশিষ্ট্য বা লক্ষন থাকে। এ
বৈশিষ্ট্যগুলো আকৃতি,গঠন,দৈহিক খন্ডায়ন,দৈহিক প্রতিসাম্য,দেহগহবর,লিঙ্গ,জীবনচক্র
প্রভৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনে প্রাণিদেহের এসব
বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।নিচে প্রাণিদের এমন কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের
সংক্ষিপ্ত বিবরন দেওয়া হল যেগুলো শেণিবিন্যাসের ভিত্তি রচনায় অবদান রাখতে সক্ষম।
প্রান্তিকতা[Polarity]:
একটি প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঞ্চল নির্দেশ করতে কতকগুলো বিশেষ শব্দ ব্যবহৃত
হয়।যেমনঃ
সন্মুখ[Anterior]------------মাথার প্রান্ত বা
প্রান্তের দিক।
পশ্চাত[Posterior]----------লেজের প্রান্ত বা
প্রান্তের দিক।
পৃষ্ঠীয়[Dorsal]---------------পিঠ বা পৃষ্ঠ ভাগ।
অঙ্কীয়[Ventral]-------------পেট বা তলদেশ।
পার্শ্বীয়[Lateral]--------------একপাশ বা
পাশের দিক।
মধ্যম[Sagittal]--------------দেহের
মধ্যরেখা।
নিকটবর্তী[Proximal]---------দেহের
কেন্দ্রীয় অংশের কাছাকাছি।
দূরবর্তী[Distal]----------------দেহের
নির্দিষ্ট অংশের দূরবর্তী অংশ।
বক্ষীয়[Pectoral]--------------বক্ষ অঞ্চল।
শ্রোণীয়[Pelvic]------------------নিতম্ব অঞ্চল।
অনুপ্রস্থ[Transverse]------------আড়াআড়ি তল।
ভ্রুণস্তর[Layers
of Embryo]:
যৌন জননকারী বহুকোষী প্রাণিদের জাইগোট বিভাজনের মাধ্যমে উৎ পন্ন কোষ তথা ব্লাস্টোমেয়ারগুলো
গ্যাস্ট্রুলা দশাতে যে সব স্তরে বিন্যস্ত হয় তাদের ভ্রুণস্তর বলে।এই স্তরগুলি
হচ্ছে এক্টোডার্ম,মেসোডার্ম এবং এন্ডোডার্ম।এই তিনটি স্তর থেকে বিভিন্ন ধরনের
টিস্যু,অঙ্গ ও তন্ত্র সৃষ্টি হয়।ভ্রুণস্তরের উপর ভিত্তি করে বহুকোষী প্রাণিদের
দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক]দ্বিস্তরী প্রাণী[Diploblastic Animal] যে সকল প্রাণীর ভ্রুণের গ্যাস্ট্রুলেশন পর্যায়ে কোষগুলো এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্ম নামক
দুটি কোষীয় স্তরে বিন্যস্ত থাকে,তাদের দ্বিস্তরী প্রাণী বলে।যেমন-Cnidaria পর্বের প্রাণী [Hydra]।
খ] ত্রিস্তরী প্রাণী[Triploblastic
Animal] যে সকল প্রাণীর ভ্রুণে গ্যাস্ট্রুলেশন পর্যায়ে কোষগুলো এক্টোডার্ম,
মেসোডার্ম এবং এন্ডোডার্ম নামক তিনটি কোষীয় স্তরে বিন্যস্ত থাকে তাদের ত্রিস্তিরী
প্রাণী বলে।Platyhelminthes
to Chordata পর্বের প্রাণীরা সকলেই
ত্রিস্তরী।যেমন-ফিতা কৃমি,জোক,মানুষ ইত্যাদি।
সিলোম[Coelom]ঃ
ত্রিস্তরী প্রাণীদের ভ্রুণীয় মেসোডার্ম থেকে উদ্ভূত যে ফাকা গহবরটি দেহ
প্রাচীর ও পৌষ্টিকনালির মাঝখানে অবস্থান করে এবং পেরিটনিয়াম নামক পর্দা দ্বারা
আবৃত থাকে,তাকে সিলোম বা পেরিভিসারেল গহবর বলে।মূলত ত্রিস্তরী প্রাণীদের
শ্রেনিকরনের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
সিলোমের অনুপস্থিতি,উপস্থিতি ও প্রকৃতি অনুসারে ত্রিস্তরী প্রাণীদের
তিনভাগে ভাগ করা যায়।
ক] সিলোমবিহীন[Acoelomate] যে সকল
ত্রিস্তরী প্রাণীর সিলোম থাকে না,এদের পরিবর্তে এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিসের
মধ্যবর্তী স্থান প্যারেনকাইমা জাতীয় টিস্যু দ্বারা পুর্ণ থাকে,তাদের সিলোমবিহীন
প্রাণী বলে।যেমন-ফিতাকৃমি একটি সিলোমবিহীন প্রাণী।
খ] অপ্রকৃত সিলোমেট[Pseudocoelomate] যে সকল
প্রাণীর দেহপ্রাচীর ও পৌষ্টিকনালির মধ্যবর্তী স্থানে গহবর থাকে,কিন্তু তা
মেসোডার্মাল পেরিটোনিয়াম দ্বারা আবৃত থাকে না,বরং বাইরের দিক পেশিস্তর দ্বারা
বেষ্টিত থাকে তারা অপ্রকৃত সিলোমেট প্রাণী।যেমন-গোলকৃমি নেমাটোডা পর্বের একটি
অপ্রকৃত সিলোমেট প্রাণী।
গ] প্রকৃত সিলোমেট[Eucoelomate] যে সকল
প্রাণীর দেহ প্রাচীর ও পৌষ্টিকনালির মধ্যবর্তী স্থানে মাসোডার্ম থেকে উদ্ভূত
পেরিটোনিয়াম পর্দা দ্বারা আবৃত দেহগহবর থকে,তাদের সিলোমেট প্রাণী বলে।অ্যানিলিডা
থেকে কর্ডাটা পর্বের প্রাণীরা।যেমন-জোক।আবার যখন প্রাণীদেহের প্রকৃত সিলোমটি
প্রবাহমান তরল পূর্ণ থাকে,তখন তাকে হিমোসিল বলে।এ ধরনের প্রাণীদের হিমোসিলোমেট বলা
হয়।যেমন-তেলাপোকা,শামুক ইত্যাদি।
প্রতিসাম্যতা বা প্রতিসাম্যঃ
প্রানীদেহিকে অভ্যন্তরীন অঙ্গাদিসহ সমান সমান দুটি সদৃশ অর্ধাংশে বিভক্ত
করাকে প্রতিসাম্যতা বা প্রতিসাম্য বলে।প্রতিসমতা বা প্রতিসাম্যের ভিত্তিতে
প্রাণীকুলকে প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
ক] অপ্রতিসমতা বা অপ্রতিসাম্য[Asymmetry] যখন কোন
প্রাণীদেহকে দুই বা ততোধিক সদৃশ অংশে ভাগ করা যায় না,তখন তাকে অপ্রতিসাম্য
বলে।যেমন-অধিকাংশ স্পঞ্জ,শামুক ইত্যাদি প্রাণি।
খ] প্রতিসমতা বা প্রতিসাম্য[Symmetry] কোন
প্রাণিদেহেকে তার কেন্দ্রীয় অক্ষ বা তল বরাবর দুই বা ততোধিক সদৃশ অংশে ভাগ করাকে
প্রতিসাম্য বা প্রতিসমতা বলে।প্রতিসাম্য প্রাণিকুলকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়-
১] গোলীয় প্রতিসমতা[Shperical Symmetry] একটি গোলককে
তার কেন্দে বরাবর যে কোন তলে যেমন দুটি সমান\সদৃশ অংশে ভাগ করা যায়।তেমনি
প্রাণিদেহকে ভাগ করা গেলে তাকে গোলীয় প্রতিসমতা বলে।যেমন-Volvox globator, Radiolaria, Heliozoa ইত্যাদি।
২] অরীয় প্রতিসমতা[Radial Symmetry] কোন প্রাণীর
দেহকে টার অনুদৈর্ঘ অক্ষ বরাবর বা অরীয়ভাবে যে কোন তলে ছেদ করে দুটি বা ততোধিক
সমান অংশে ভাগ করা যায়,তাকে অরীয় প্রতিসাম্য প্রাণি বলে।এ সকল প্রাণি কখনও গোলাকার
হয় না।যেমন-Hydra, Asterias
rubens, Metridium senile ইত্যাদি।
৩] দ্বি-পার্শ্বীয় প্রতিসম[Birlateral Symmetry] যখন কোন প্রাণীকে টার
দেহের কেন্দ্রীয় অক্ষ বরাবর মাত্র একবার দুটি সদৃশ ও সমান অংশে ভাগ করা যায়,তখন
তাকে দ্বি-পার্শ্বীয় প্রতিসমতা বলে।যেমন-রেশম পোকা[Bombyx mori] প্রজাপতি[Bicyclus
anynana]মানুষ[Homo sapiens] ইত্যাদি।
নটোকর্ড[Notocord]:
ভ্রুণ দেহের কাঠামো গঠনকারী নিরেট ও স্থিতিস্থাপক দন্ডকে ন্টোকর্ড
বলে।ন্টোকর্ডের উপস্থিতির ভিত্তিতে প্রাণীকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-
ক] নন-কর্ডাটাঃ এ সকল প্রাণীতে নটোকর্ড অনুপস্থিত।যেমন-পরিফেরা পর্ব থেকে
ইকাইনোডার্মাটা পর্বের প্রাণী।
খ] কর্ডাটাঃ এ সকল প্রাণীর নটোকর্ড উপস্থিত।যেমন-কর্ডাটা পর্বের সকল
প্রাণী।
তল[Planes]:
দৈহিক তল প্রাণীর শ্রেনীকরনের একটি গুরুত্বপূর্ন ভিত্তি।যে অঞ্চল বরাবর
প্রাণীদেহকে ডান ও বাম বা অনুদৈর্ঘ্য ও অনুপ্রস্থ বা সন্মূখ ও পশ্চাৎ অঞ্চল বরাবর দুইভাগে ভাগ করা যায়,তাকে তল
বলে।প্রাণীদেহে সাধারনত তিন ধরনের তল দেখা যায়-
ক] মধ্যরেখীয় তল[Median or Sagital plane] যে তলের
মাধ্যমে দেহের কেন্দ্রীয়,পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয় অক্ষ বরাবর দেহকে পার্শ্বীয় ভাবে ডান ও
বাম অর্ধাংশে ভাগ করা যায়,তাকে মধ্যরেখীয় তল বলে।
খ] সন্মুখ তল[Frontal plane] যে তলের
মাধ্যমে দেহের পার্শ্বীয় লম্বালম্বি অক্ষ বরাবর দেহকে পৃষ্ঠীয় ও অঙ্কীয় এই দুটি
অংশে ভাগ করা যায়,তাকে সন্মুখ তল বলে।
গ] অনুপ্রস্থ তল[Transverse plane] যে তলের
মাধ্যমে দেহের মধ্যরেখীয় তলের সমকোন বরাবর দেহকে সন্মুখ ও পশ্চাৎ অর্ধাংশে ভাগ করা যায়,তাকে অনুপ্রস্থ তল
বলে।
খন্ডায়ন বা খন্ডীভবন[Segmentation or Metamerism] প্রাণীদেহে
সদৃশ একাধিক দেহখন্ডের পুনরাবৃত্তিকে খন্ডায়ন বলে।প্রাণীদেহের এরুপ প্রতিটি
খন্ডককে মেটামিয়ার বা সোমাইট বলে।গঠন ভেদে খন্ডায়ন দুই প্রকার, যথা-
ক] সদৃশ খন্ডায়ন[Homonomous Metamerism] খন্ডায়নগুলো
যদি হুবহু একই রকমের হয়,তবে তাকে সদৃশ খন্ডায়ন বলে।যেমন-কেচোর দেহের খন্ডায়ন।
খ] বিসদৃশ খন্ডায়ন[Heteronomous Metamerism] খন্ডায়নগুলো যদি হুবহু
একই রকম না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়,তাকে বিসদৃশ খন্ডায়ন বলে।যেমন-পতঙ্গের দেহের
খন্ডায়ন।
অবস্থানভেদে খন্ডায়ন দুই প্রকার,যথা-
ক] সম্পূর্ণ খন্ডায়ন[Complete Metamerism] যখন খন্ডায়নগুলো
প্রাণীর দেহের বাহিরে ও ভেতরে উভয় অঞ্চলে সমানভাবে বিস্তৃত থাকে তখন তাকে সম্পূর্ণ
খন্ডায়ন বলে।যেমন-কেচো, জোক প্রভৃতির খন্ডায়ন।
খ] অসম্পূর্ণ খন্ডায়ন[Incomplete Metamerism] যখন খন্ডায়নগলো
প্রাণীর দেহের বাহিরে বা ভেতরে যে কোন একদিকে সীমাবদ্ধ থাকে,তখন তাকে অসম্পূর্ণ
খন্ডায়ন বলে।অসম্পূর্ণ খন্ডায়ন আবার দুই প্রকার, যথা-
অ] বহিঃখন্ডায়নঃ খন্ডায়নগুলো কেবলমাত্র বাহিরে সীমাবদ্ধ থাকে।যেমন-তেলাপোকা,মাছি
প্রভৃতির খন্ডায়ন।
আ] অন্তঃখন্ডায়নঃ
খন্ডায়নগুলো কেবলমাত্র দেহের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকে।মেরুদন্ডের কশেরুকা,অন্ত্রের
খন্ডায়ন।
প্রকৃতিভেদে খন্ডায়ন দুই প্রকার,যথা-
ক] প্রকৃত খন্ডায়ন[True Metamerism] খন্ডায়নগলো
একই ধরনের হলে এবং তা দেহ থেকে বিচ্যুত না হলে তাকে প্রকৃত খন্ডায়ন বলে।যেমন-কেচো,
তেলাপোকা প্রভৃতির খন্ডায়ন।
খ] অপ্রকৃত খন্ডায়ন[Pseudo Metamerism] খন্ডায়নগুলো
ভিন্ন ধরনের হলে এবং তা দেহ থেকে বিচ্যুত না হলে তাকে অপ্রকৃত খন্ডায়ন
বলে।যেমন-ফিতা কৃমির খন্ডায়ন।এরুপ খন্ডায়নগুলোকে প্রোগ্লোটিডও বলে।
নির্দেশনাঃডঃশিল্পী রানী সাহা,রনজিত কুমার সাহা প্রমুখ লেখক গনের সহায়তায় লিপিবদ্ধ।
No comments:
Post a Comment