মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ
যেখানে রয়েছে জীবন এবং লক্ষ লক্ষ জীবের সমাবেশ।পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত প্রানী-প্রজাতির সংখা প্রায় পনের
লক্ষ।এদের গঠন,আবাস,কাজ,আচরন,অভ্যাস ইত্যাদিতে রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নতা।সাধারন ভাবে
এটাই হচ্ছে প্রাণিবৈচিত্র বা Animal
Diversity ।Animal diversity শব্দটি Biodiversity-র অংশবিশেষ
যা কেবলমাত্র প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য।১৯৮০ সালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধের শিরোনামে[“Changes in Biological Diversity”and “Ecology and
living resources-Biological Diversity”]প্রথম Biological Diversity শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়।Biological
ও Diversity
শব্দ দু’টিকে একত্রিত করে যুক্তরাষ্টের বিজ্ঞানী Walter G. Rosen[1986]প্রথম Biodiversity শব্দটি ব্যবহার করেন।
প্রাণিকুলের পারস্পরিক সাদৃশ্য ও
বৈসাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে প্রাণিসমুহকে পর্ব,শ্রেনী,বর্গ,গোত্র,গন,প্রজাতি
ইত্যাদি স্তর বা উপস্তরে বিন্যস্ত করাকে বলা হয় শ্রেনীবিন্যাস।বিশাল বৈচিত্রময়
প্রাণিজগত সম্পর্কে অল্প সময়ে কম পরিশ্রমে সংক্ষেপে জানার জন্য প্রয়োজন একটি
উপযুক্ত শ্রেনীবিন্যাস।প্রাণিজগতের প্রধান বা মেজর পর্ব দুটি নন-কর্ডেট এবং
কর্ডেট, নিম্নে নন-কর্ডাটা এর শেনীবিন্যাস আলোচিত হলঃ
Porifera: [Porus=ছিদ্র+Ferre=বহন করা]
বিজ্ঞানী Robert
Grant[1836] সর্বপ্রথম পরিফেরা পর্বটির নামকরন করেন।এই
পর্বের আবিস্কৃত মোট প্রজাতির সংখা প্রায় ৯,০০০।এই পর্বের প্রানিগুলো সাধারনত
‘স্পঞ্জ’ নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য
১] দেহে অস্টিয়া নামক অসংখ্য ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র এবং অস্কুলা নামক এক বা একাধিক ছিদ্র থাকে।এই অস্কুলামের মাধ্যমে দেহের
অভ্যন্তরে স্পঞ্জোসিল নামক গহবর দেহের বাইরে উন্মুক্ত হয়।
২] দেহের কোষগুলোর বাইরে পিনাকোডার্ম ও
ভেতরে কোয়ানোডার্ম নামক দুটি স্তরে বিন্যস্ত থাকে।স্তর দুটির মাঝে মেসেনকাইম নামক
জেলির মত অকোষীয় পদার্থ থাকে।
৩] দেহে অ্যাসকোনয়েড,সাইকনয়েড ও লিউকোনয়েড
নামক বিভিন্ন ধরনের নালিতন্ত্র দেখা যায় এবং এদের অন্তঃকংকাল ক্যালসিয়াম বা
সিলিকার তৈরি স্পিকিউল তন্তু বা স্পঞ্জিন তন্তু বা উভয় দ্বারা গঠিত।
৪] এদের যৌন ও অযৌন উভয় ধরনের প্রজনন পদ্ধতি
দেখা যায় এবং জীবনচক্রে Amphiblastula ও Parenchymula লার্ভা দেখা যায়।
৫] এরা সকলে সামূদ্রিক,কংকালতন্ত্র বিহীন
এবং দ্বিস্তরীভূত।
উদাহরনঃ Scypha
gelatinosum, Spongilla locustria, ইত্যাদি।
Cnidaria বা Coelenterata: [Gr.Knide=ক্ষুদ্র আকৃতির কাটা(L)area=সংযুক্তি]
এই পর্বটির নামকরন করেন Hatschek[1888]।এই পর্বের আবিস্কৃত মোট প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১০,০০০।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] এরা বহুকোষী,দ্বিস্তরী,বাইরের স্তর
এক্টোডার্ম ও ভেতরের স্তর এন্ডোডার্ম নামে পরিচিত।স্তর দুটির মাঝে মেসোগ্লিয়া নামক
অকোষীয় স্তর বিদ্যমান।
২] দেহের অভ্যন্তরে সিলেন্টেরন নামক একটি
প্রশস্ত গহবর বিদ্যমান।
৩] এক্টোডার্মে নেমাটোসিস্ট ধারনকারী
নিডোব্লাস্ট নামক বিশেষ ধরনের কোষ বিদ্যমান।
৪] পরিপাক অন্তঃকোষীয় ও বহুকোষীয় এবং
মুখছিদ্রের চারিদিকে অনেক কর্ষিকা থাকে।
৫] জীবনচক্রে পলিপ[অযৌন দশা]এবং মেডুসা[যৌন
দশা] দেখা যায়।
উদাহরনঃ Hydra valgaris,
Aurelia aurita.
Platyhelminthes or Plathelminthes:[Gr.Platys=Flat+Helminth=wormচ্যাপ্টা কৃমি]
বিজ্ঞানী Karl
Gegenbaur [1859] সর্বপ্রথম এই পর্বটির নামকরন করেন।আবিস্কৃত মোট প্রজাতির সংখা প্রায়
২০,০০০।পর্বটির প্রানিগুলো সাধারনত ‘চ্যাপ্টাকৃমি’ নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্যঃ
১]
দেহপৃষ্ঠ-অঙ্কীয়ভাবে চ্যাপ্টা,দ্বি-পার্শ্বীয় প্রতিসম, অধিকাংশই পরজীবী এবং
পৌষ্টিকনালী অসম্পূর্ন।
২] দেহ
ত্রিস্তরী,এক্টোডার্ম,মেসোডার্ম এবং এন্ডোডার্ম স্তরে বিভেদিত।
৩] সিলোমবিহীন
মেসোডার্ম থেকে উৎপন্ন প্যারেনকাইমা জাতীয় কোষ দেহের অভ্যন্তরে ফঁাকা স্থাঙ্গুলো পূর্ণ
করে।
৪] রেচন অঙ্গ শাখা-প্রশাখা যুক্ত এবং শিখা কোষ নামে পরিচিত।
৫] জীবনচক্রে Miracidium,Radia প্রভৃতি লার্ভা দশা দেখা যায়।
উদাহরনঃ Fasciola hepatica,
Taenia solium ইত্যাদি।
Nematoda:[Gr.Nematos=Thread+eidos=সূতা আকৃতি]
বিজ্ঞানী K.M.Diesing[1861]প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।এই পর্বের শনাক্তকৃত মোট
প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২৮,০০০।পর্বটির প্রানিগুলো সাধারন্ত সুতাকৃমি নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] দেহ লম্বা ,
নলাকার,অখন্ডায়িত সুতার মত,পুরু কিউটিকল দ্বারা আবৃত এবং দেহ প্রাচীরে অনুদৈর্ঘ্য
পেশি থাকে কিন্তু বৃত্তাকার পেশি থাকে না।
২] এরা ত্রিস্তরী ও
সিউডোসিলোমেট,এদের অধিকাংশ পরজীবী,কিছু মুক্তজীবী,সাধারন্ত একলিঙ্গ ও যৌন
দ্বিরুপতা সুস্পষ্ট।
৩] পৌষ্টিকনালী সোজা,অশাখান্বিত
ও সম্পূর্ণ কিন্তু পৌষ্টিক গ্রন্থি অনুপস্থিত।
৪] দেহে রক্তসংবহন
তন্ত্র অনুপস্থিত, তবে স্নায়ুতন্ত্র ও একজোড়া পার্শ্বীয় রেচননালী নিয়ে রেচনতন্ত্র
গঠিত।
৫] এদের কোন কোন
প্রজাতিতে র্যাবডিটিফর্ম ও মাইক্রোফাইলোরিয়া লার্ভা দশা দেখা যায়।
উদাহরনঃ Ascaris lumbricoides,
Wuchereria bancrofti
ইত্যাদি।
Mollusca: [Gr.Mollis=কোমল বা নরম]
বিজ্ঞানী Linnaeus [1758]এই পর্বটির নামকরন করেন। আবিস্কৃত মোট প্রজাতির সংখ্যা
প্রায় ৮৫,০০০। পর্বটির প্রানিগুলো সাধারন্ত ‘Molluscs or mollusks’নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] দেহ নরম, ম্যান্টল
নামক পর্দা দ্বারা আবৃত,অখন্ডায়িত,দ্বিপাশ্বীয় প্রতিসম বা অপ্রতিসম।
২] ত্রিস্তরী ও প্রকৃত
সিলোমেট, সিলোম হিমোসিল প্রকৃতির এবং কেবলমাত্র হ্নদপিন্ড,জনন অঙ্গ, ও বৃক্কে
সীমাবদ্ধ থাকে।
৩] ম্যান্টাল পর্দা
থেকে ক্যালসিয়াম নিঃসৃত হয়ে অনেক প্রজাতিতে দেহের বাইরে বা দেহের ভিতরে খোলক থাকে
এবং পৌষ্টিকনালী সম্পূর্ণ,প্যাচানো বা Uআকৃতির।
৪] রক্ত সংবহনতন্ত্র
আংশিক মুক্ত বা বদ্ধ এবং ফুলকা বা ম্যান্টল পর্দার সাহায্যে শ্বসন সম্পন্ন করে।
৫] প্রিস্ফুটনকালে
ট্রোকোফোর বা গ্লোচিডিয়াম লার্ভা দশা দেখা যায়।
উদাহরনঃ Pila globosa , Lamellidens marginalis ইত্যাদি।
Annelidia: [Annulus=little
ring ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আংটি]
বিজ্ঞানী লেমার্ক ১৮০৯
সালে সর্ব প্রথম এই পর্বটির নামকরন করেন।আবিস্কৃত মোট প্রজাতির সংখ্যা ২২,০০০
প্রায়।এই পর্বটির প্রানিগুলি সাধারনত রিং ওয়ার্ম নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] দেহ লম্বা নলাকার
বা কিছুটা চ্যাপ্টা,অসংখ্য সরু আংটির মত খন্ড বা সম্পূর্ণ খন্ডায়িত এবং
দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম।
২] ত্রিস্তরী,প্রকৃত
সিলোমেট এবং প্রধান রেচন অঙ্গ নেফ্রেডিয়া।
৩] প্রধান চলন অঙ্গ
সিটা বা প্যারাপোডিয়া ।
৪] রক্ত সবহনতন্ত্র
বদ্ধ,রক্তরসে হিমোগ্লোবিন নামক লাল রঞ্জক কনিকা থাকে,তবে লোহিত রক্ত কনিকা থাকে
না।
৫] জীবনচক্রে
ট্রোকোফোর লার্ভা দেখা যায়।
উদাহরনঃ Hirudo medicinalis, Metaphire posthuma ইত্যাদি।
Arthropoda: [Gr.Arthos=সন্ধি+Podos=পদ]
Latreille [1829] সর্বপ্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন।আবিষ্কৃত
মোট প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১,১৭০,০০০ যা সমস্ত প্রজাতির ৮০%।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] দেহ সন্ধিযুক্ত
উপাঙ্গবিশিষ্ট।বহিঃখন্ডকিত,কাইটিন নির্মিত বহিঃকঙ্কাল দ্বারা আবৃত এবং শিরঃবক্ষ ও
উদরে বিভক্ত।
২] প্রকৃত সিলোম
বিদ্যমান যা হিমোসিল ধরনের এবং হিমোলিম্ফ নামক তরলে পূর্ণ।
৩] প্রধান শ্বসন
অঙ্গগুলি হচ্ছে ফুলকা,বকলাং,ট্রাকিয়া, বুকগিল,দেহত্বক,এবং প্রধান রেচন অঙ্গগুলি
ম্যালপিজিয়ান নালিকা,সবুজ গ্রন্থি,কক্সাল গ্রন্থি।
৪] রক্ত সংবহনতন্ত্র
মুক্ত এবং প্রধান দর্শনেন্দ্রিয় পুঞ্জাক্ষি বা সরলাক্ষি।
৫] পরিস্ফুটন সরাসরি
বা লার্ভাদশার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
উদাহরনঃ Periplaneta Americana , Apis indica ইত্যদি।
Echinodermata Gr.Echinos=কন্টক +Derma=ত্বক]
বিজ্ঞানী Klein [1734] এই পর্বটির নামকরন করেন। আবিস্কৃত মোট
প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭,০০০।
বৈশিষ্ট্যঃ
১] দেহত্বক
কন্টকযুক্ত,পরিনত অবস্থায় অরীয় প্রতিসম,অন্তঃকঙ্কাল ক্যালসিয়াম-কার্বনেট নির্মিত
অসংখ্য অসিকল বা স্পাইন নিয়ে গঠিত।
২] দেহ সাধারনত ওরাল ও
অ্যাবোরাল তলে বিভক্ত এবং ত্বকীয় ফুলকা বা প্যাপুলি শ্বসন অঙ্গ হিসাবে কাজ করে।
৩] দেহের অভ্যন্তরে
উন্নত ধরনের পানি সংবহনতন্ত্র থাকে এবং নালি পদের সাহায্যে চলন সম্পন্ন করে থাকে।
৪] এদের নির্দিষ্ট
রেচনতন্ত্র অনুপস্থিত, রক্তসংবহনতন্ত্র অনুপস্থিত তবে হিমাল ও পেরিহিমালতন্ত্র
সংবহন্তন্ত্রের কাজ করে , সেইসাথে স্নায়ুতন্ত্র ও জ্ঞানেন্দ্রিয় অনুন্নত।
৫]এদের জীবনচক্রে
বাইপিনারিয়া, ব্রাকিওলারিয়া, প্লুটিয়াস প্রভৃতি মুক্ত সন্তরনশীল লার্ভা দশা দেখা
যায়।
উদাহরনঃ Asterias rubens , Cucumaria frondosa ইত্যাদি।
Reference: প্রফেসর
মেঘনাদ সাহা,প্রফেসর আবু সাঈদ বিশ্বাস,প্রফেসর রনজিৎ কুমার সাহা,ডঃ শিল্পী রানী
সাহা প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment