অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি ও হরমোন
গঠনগত ও কার্যগত ভাবে বিশেষিত নালীহীন বা একপ্রকার রুপান্তরিত আবরনী কলা
যখন বিভিন্ন রাসায়নিক বৈচিত্র সম্পন্ন পদার্থ বা রস নিজের মধ্যেই ক্ষরিত করে এবং
উক্ত রস সরাসরি রক্ত বা লসিকার সাথে মিশ্রিত হয়,তাদের নালীহীন বা অনাল গ্রন্থি
বলে।
অন্যভাবে বলা যায়,যে সমস্ত গ্রন্থি তাহাদের ক্ষরন পদার্থকে[হরমোন]সরাসরি
গ্রন্থির অন্তঃস্থ কলারস বা রক্ত প্রবাহে নিঃসৃত করে,তাহাদেরকে অন্তঃক্ষরা বা
অনালী গ্রন্থি বলে।কারন,এই সমস্ত গ্রন্থির মধ্যে কোন নল বা নালিকা দেখা যায় না এবং
অনালী গ্রন্থির তৈরি রস সেই গ্রন্থির মধ্যেই ক্ষরিত হয়।
এই সমস্ত গ্রন্থি হতে নিঃসৃত পদার্থের নাম হরমোন বা প্রাণরস।তাহলে হরমোন
বলতে আমরা বুঝি-যে বিশেষ রাসায়িনিক পদার্থ জীবদেহের একাংশের বিশেষ কোষ বা
কোষসমষ্টি দ্বারা ক্ষরিত হয় এবং রক্ত বা দেহ রসের মাধ্যমে স্বল্প পরিমানে বাহিত
হয়ে দেহের অপরাংশের বিপাকীয় কার্যকে প্রভাবিত করে জীব দেহের বিভিন্ন জৈবনিক
কার্যের সমন্বয় সাধন করে জীবকে একটি একক সংগঠন রুপে প্রভাবিত করে।
মানব দেহে যে সকল অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থাকে তাদের নাম,অবস্থান ও কার্য
সন্মদে নিন্মে আলোচনা করা হলঃ
A.পিটুইটারী
গ্রন্থিঃ মস্তিষ্কের ডায়েন সেফানলে অবস্থিত সকল গ্রন্থি নিয়ন্ত্রনকারী একটি ক্ষুদ্র
গ্রন্থি যার নিঃসৃত হরমোনের সংখ্যা অনেক,এই গ্রন্থিটিকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়, যথাঃ
ক]অগ্র পিটুইটারী,
খ]মধ্য
পিটুইটারী,
গ]পশ্চাৎ পিটুইটারী।
ক] অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থিঃ
এ গ্রন্থি থেকে ৬টি হরমোন নিঃসৃত হয়, যথাঃ-
১] সোমাটোট্রপিন হরমোন, মানব দেহ ও অস্থির বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
২] অ্যাড্রিনাল উদ্দীপক হরমোন, দেহে অ্যাড্রিনাল কর্টেক্সের বৃদ্ধি ও ক্ষরন
নিয়ন্ত্রন করে।
৩] থাইরয়েড উদ্দীপক হরমোন, থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃসরনকে নিয়ন্ত্রন করে।
৪] লিউটিনাইজিং হরমোন, পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোনের ক্ষরন নিয়ন্ত্রন করে
এবং মহিলাদের ওভু্যলেসন ও কার্পাশ লিউটিয়াম তৈরি নিয়ন্ত্রন করে।
৫] ফলিকল উদ্দীপক হরমোন, মহিলাদের ডিম্বাশয়ে ফলিকল কোষ এবং পুরুষে শুক্রানু
উ পাদন নিয়ন্ত্রন করে।
৬] প্রোল্যাকটিন হরমোন,মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালে স্তনের বৃদ্ধি এবং উহাতে
দুগ্ধ প্রস্তুত ও নিঃসরনে সহায়তা করে।
খ] মধ্য পিটুইটারীবগ্রন্থিঃ
এ গ্রন্থি হতে মেলানোসাইট নামক হরমোন নিঃসৃত
হয়, দেহের মেলানোফোর কোষের বিস্তৃতি ঘটিয়ে ত্বকের রঙ নিয়ন্ত্রন করে।
গ] পশ্চাৎ পিটুইটারী গ্রন্থিঃ
এ গ্রন্থি থেকে দুই ধরনের
হরমোন নিঃসৃত হয়-
১] ভেসোপ্রেসিন, অনৈচ্ছিক পেশীর সংকোচন নিয়ন্ত্রন ও বৃক্ক হতে পানি শোষন
করে এবং মুত্রে পানির পরিমান নিয়ন্ত্রন করে।
২] অক্সিটোসিন, প্রসবের সময় জড়ায়ু পেশীর সংকোচন ঘটায় ফলে প্রসব সহজতর হয়।
এই গ্রিন্থিটি কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন নিঃসরন করা ছাড়াও দেহের অন্যান্য
গ্রন্থির ক্রিয়া কলাপ নিয়ন্ত্রন করে বলে এই গ্রন্থিটিকে প্রভূ গ্রন্থি বলে। এই
হরমোন পেশীকলার উপর সরাসরি কাজ করে বলে শৈশবে এর ক্ষরন কম হলে বামন দশা এবং বেশি
হলে দানব দশা দেখা যায়।আবার প্রাপ্তবয়স্কে এর ক্ষরন বেশি হলে মানুষ গরিলা দশেয়
উপনীত হয়।
B.পিনিয়াল গ্রন্থিঃ
ডিম্বাকৃতি ক্ষুদ্র এই
গ্রন্থি মস্তিষ্কের পৃষ্ঠীয় দিকে পিটুইটারী গ্রন্থির বিপরীত পৃষ্ঠে অবস্থিত।
পিনিয়াল হতে মেলাটোনিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়ে দেহে ফসফরাস বিপাক দ্রুত করে এবং যৌণ
অঙ্গের সক্রিয়তা ঘটায়।
C.থাইরয়েড গ্রন্থিঃ
এই গ্রন্থিটি শ্বাস
নালীর উভয় পাশে হরিদ্রাব লালবর্নের দুটি পিন্ডের মত।ইহা হতে তিন ধরনের হরমোন
নিঃসৃত হয় যথা-
১] থাইরক্সিন, ইহা গ্লুকুজের পরিমান বৃদ্ধি করে নতুন গ্লুকুজ উ পাদনে
সহায়তা করে, দৈহিক, মানসিক ও যৌন লক্ষন প্রকাশ ঘটায় এবং বিপাকে সহায়তা করে।
২] ট্রাই আয়োডো থাইরক্সিন, ইহাও দৈহিক,মানসিক বৃদ্ধি ঘটায় এবং যৌন লক্ষন
প্রকাশে সহায়তা করে।
৩] ক্যালসিটোসিন, রক্তে ক্যালসিয়াম আয়নের ঘনত্ব কমায়।
এই হরমোনের অভাবে শিশুদের বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জনন
শক্তি ও বিপাকীয় ক্রিয়া হ্রাস পায়।
D.প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থিঃ
থাইরয়েড গ্রন্থির
পৃষ্ঠদেশে অতি ক্ষুদ্র ডিম্বাকৃতি দুই জোড়া গ্রন্থি।এই গ্রন্থি হতে নিঃসৃত হরমোনের
নাম প্যারাথহরমোন। ইহা ক্যালসিয়াম-ফসফরাসের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন ও বিপাকে সহায়তা
করে।
এই হরমোনের অভাবে ন্সায়ু ও পেশীর আক্ষেপ বেড়ে যায় এবং পেশীর খিচুনী শুরু
হয়ে টিটেনি নামক রোগ হয়।
E.থাইমাস গ্রন্থিঃ
শ্বাসনালীর সামনে
থাইরয়েড গ্রন্থির নিম্নপ্রান্তে ও বক্ষের উরুঃফলকের পিছনে অবস্থিত।এই গ্রিন্থি হতে
থাইমোক্রাইসিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়।ইহা এন্টিবডি প্রস্তুত,কৈশোরে যৌন পরিপক্কতায়
সাহায্য করে।শৈশবে গ্রন্থিগুলি বেশ বড় থাকে এবং হূদপিন্ডের কিছু অংশ ঢেকে রাখে।কিন্তু
বয়োসন্ধির সাথে সাথে ছোট হয়ে যায়।
F.গ্যাসট্রিক গ্রন্থিঃ
পাকস্থলির
অন্তঃপ্রাচীরে বেশ কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্যাসট্রিক গ্রন্থি অবস্থিত।ইহা হতে
নিঃসৃত হরমোনের নাম গ্যাস্ট্রিন হরমোন।ইহা পাচক রস নিঃসরনে সহায়তা করে।
G.ডিওডেনাম গ্রন্থিঃ
ডিওডেনামের ভেতরের
গাত্রে এই ক্ষুদ্র গ্রন্থি অবস্থিত।ইহা হতে তিন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়-
১] সিক্রেটিন, অগ্নাশয়কে উদ্দীপ্ত করে ও অগ্নাশয় রস ক্ষরনে উত্তেজিত করে।
২] কোলিসিস্টোকাইনিন, পিত্তথলির সঞ্চিত পিত্ত ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করাতে
সাহায্য করে।
৩]এন্টারোগ্যাস্ট্রিন, পাচক রস ক্ষরনে বাধা দেয় এবং আন্ত্রিকরস ক্ষরনে
সাহায্য করে।
H.আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যস্নঃ
অগ্ন্যাশয়ের
মধ্যে অবস্থিত ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের ন্যায় গ্রন্থি।এই গ্রন্থি হতে দুই ধরনের হরমোন
নিঃসৃত হয়-
১] গ্লোকোগন, ইহা রক্তে গ্লোকোজের পরিমান বাড়ায়।
২] ইনস্যুলিন, ইহা কার্বোহাইড্রেট বিপাক নিয়ন্ত্রন করে এবং রক্তে গ্লোকোজের
পরিমান কমায়।
গ্লোকোগন নীঃসৃত হয়ে পোট্রাল তন্ত্রের মাধ্যমে যকৃতে যায় এবং যকৃতে মজুদ
গ্লাইকোজেনকে ভেঙ্গে রক্তে গ্লুকুজের পরিমান বৃদ্ধি করে।অপরদিকে ইন্স্যুলিন শর্করা
জাতীয় খাদ্যের বিপাক নিয়ন্ত্রন করে।ইহার অভাবে গ্লোকোজ প্রস্রাবের সাথে বাহির
হয়,ফলে প্রানী বহুমূত্র বা ডায়াভেটিস রোগে আক্রান্ত হয়।এ রোগ নিরাময় যোগ্য নয়,তবে
খদ্য নিয়ন্ত্রন,নিয়মিত ব্যায়াম,শৃংখলাপূর্ণ জীবনযাপন এবং ইনস্যুলিন গ্রহনের
মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়।
I.অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিঃ
প্রতিটি বৃক্কের
মাথায় টুপির ন্যায় দুটি গ্রন্থি অবস্থিত।এই গ্রন্থি হতে চার ধরনের হরমোন নিঃসৃত
হয়,যথা-
১] গ্লুকোকর্টিকয়েড,ইহা শর্করা ও আমিষ বিপাকে সাহায্য করে।
২] মিনারেলোকর্টিকয়েড,যা সোডিয়াম ও পটাশিয়াম বিপাকে সাহায্য করে।
৩] সেক্স কর্টিকয়েড, মুখ্য ও গৌন যৌন গ্রন্থির বৃদ্ধি ও পুষ্টি যোগায়।
৪] অ্যাড্রেনালিন,জরুরী বিপাকে সাহায্য করে এবং এর প্রভাবেই গায়ের লোম খাড়া
হয় ও ঘাম হয়।
এই গ্রন্থি নিঃসস্রিত হরমোন রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রন করে এবং
হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে।যৌনাঙ্গের বৃদ্ধির উপর এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
J.বৃক্কীয় গ্রন্থিঃ
বৃক্কের কিছু হরমোন
গ্রন্থি তৈরিতে অংশ নেয়।এই গ্রন্থি হতে নিঃসৃত হরমোনের নাম এরিথ্রোপয়েটিন,ইহা
সম্ভবত লোহিত কনিকা তৈরিতে উদ্দীপনা যোগায়।
K.অমরাঃ
অস্থায়ী এই গ্রন্থি গর্ভবতী রমণীর
জরায়ুগাত্রে অবস্থিত।এটি হতে দুই ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়-
১] কোরিয়নিক গোনাডোট্রোপিন হরমোন, ডিম্বাশয়ের হর্মোনগুলোর ভারসাম্য
নিয়ন্ত্রন করা এই হরমোনের কাজ।
২] কোরিয়নিক প্রোলেকটিন হরমোন, ভ্রুনের শক্তি যোগিয়ে ভ্রুনের স্বাভাবিক
অবস্থা ও পরিবর্তন নিয়ন্ত্রন করে দুগ্ধ উ পাদনে ভূমিকা রাখ।
L.শুক্রাশয়ঃ
পুরুষ জননতন্ত্রের
প্রধান অঙ্গ।এরা ডিম্বাকৃতি ও প্রত্যেকটির ওজন ১০-২০ গ্রাম।উদরের নিচে প্রতিটি
শুক্রথলিতে একটি করে মোট দুইটি শুক্রাশয় অবস্থিত।এটি হতে দুই ধরনের হরমোন নিঃসৃত
হয়,যথা-
১] টেস্টোস্টেরন, পুরুষের যৌন লক্ষন এর প্রকাশ ঘটায় এবং শুক্রাণুর পরমায়ু
ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
২] অ্যান্ডোস্টেরন, পেনিস সহ অন্যান্য যৌণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও যৌবনের লক্ষনের
বিকাশ ঘটায়।
M.ডিম্বাশয়ঃ
উদরের মধ্যে ডিমের
ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট দুটি ডিম্বাশয় অবস্থিত।এর দৈর্ঘ্য ৩ সেমি.পুরু ১ সেমি.ওজন প্রায় ৫
গ্রাম।এটি হতে তিন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়,যথা-
১]ইস্ট্রোজেন, মেয়েদের নারী সুলভ লক্ষন সৃষ্টি করে,স্তন,লোম বৃদ্ধি পায় এবং
দেহত্বক কোমল হয়।
২] প্রোজেস্টেরন, অমরা গঠিত হয়,রজঃচক্র নিয়ন্ত্রন করে,গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের
বৃদ্ধি ও পুষ্টি যোগায়।
৩] রিলাক্সিন, গর্ভাবস্থায় শ্রোণিবন্ধনী শিথিল করে এবং জড়ায়ু পেশীর
সুংকোচনে বাধার সৃষ্টি করে।
No comments:
Post a Comment